খালের নাম বড়বুচি নালা

শেষ পাতা

॥কৃষিবিদ বীরেন্দ্র লাল রায়॥
খালের নাম বড়বুচি নালা। খালটি ৩০/৩৫ বছর যাবৎ সংস্কারের অভাবে মৃতপ্রায় হতে হতে নালায় পরিনত হয়েছে। দীর্ঘ অতীতে খনন, পূণঃখনন, লোপকাটিং কিংবা পানি নিষ্কাশন রেগুলেটর কোন কিছুই এতে করা হয়নি। ফলে বছরের পর বছর পাহাড়ী ঢলের পানি নিষ্কাশনের অভাবে ফসল হারিয়ে লাদিয়া, বরাবদা, একডালা এবং মহাদিরকোণা এই ৫টি মৌজার ৭২৩টি বসতবাড়ীর প্রায় ৩০০০ গ্রামবাসী ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছেন। বড়বুচি নালাটির উৎপত্তি চুনারুঘাট উপজেলা থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে মিরাশি ইউনিয়নে এক বিস্তীর্ণ আমন ধানের মাঠ “চালবন্দ” থেকে। হাত ধোঁয়ার বেসিনের মত চালবন্দের মাঠটি রেমা, মুছাকান্দি পাহাড় থেকে নেমে আসা ভীষণ পাহাড়ী ঢলে বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে একবার আর ভাদ্র-আশ্বিন মাসে আরেকবার নোয়াগাঁও, কবলাশপুর, বাশুল্লা বাজার হয়ে এলাকাবাসীর বিস্তীর্ণ রোপা আমন আর আউশ ক্ষেত তলিয়ে নেয় ।
আকাবাঁকা ৩ কিলোমিটার লম্বা মাঠের বুকচিরে বয়ে চলা একমাত্র বড়বুচি নালাটি সংষ্কারের অভাবে ভরাট হয়ে যাওয়ায়; ঢলের পানি নিষ্কাশন হতে পারেনা। ৩-৭দিন পর্যন্ত পানি ধানক্ষেতে জমে থাকে। এলাকায় বৃষ্টিপাতের কারনে পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রবল বর্ষণে কৃষকদের রোপিত আউশ-আমন ফসল প্রতি বছরই ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়। রোপিত ফসলের মাঠের উপরাংশে ২-৩ ফুট এবং নি¤œাংশে ৩-৫ ফুট পর্যন্ত পানি জমে থাকে। এ কারনে প্রায় ৫০% রোপা আমন এবং ৬০% আউশ ধানের ফলন নষ্ট হয়। শীত মৌসুমে ১০% বোরো জমি পতিত থাকে। আউশ মৌসুমে ৩০% জমি সেচের পানির অভাবে রোপন করা যায় না। আর্থিক মূল্যে গরীব কৃষকদের এ ক্ষতি কোটি কোটি টাকার।
উল্লেখ্য এলজিইডি’র ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের কাছে মিরাশি ইউনিয়নের প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মোট এলাকা প্রায় ১১৭৩ একর। এর মধ্যে ৮৬০ একর জমি বিভিন্নভাবে চাষ হয়ে থাকে আর ৩১৩ একর জমি মৌসুম ভিত্তিক পতিত থাকে।
প্রবল পাহাড়ী ঢলে পশ্চিমাংশের বরাব্দা গ্রামের মানুষকে এ সময় বাড়ীঘর থেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ীতে আশ্রয় নিতে হয়। পাহাড়ী সাপ ঘরের মধ্যে এসে বাসা বাঁধে। হাঁস মুরগীকে দংশন করে। পানিতে দন্ডায়মান গরু ছাগলকে কাঁটে। এ সময় গরীব মানুষজন তাদের সহায় সম্বল গরুবাছুর নিয়ে কোথায় যাবে কিভাবে যাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে। বছর বছর ফিরে আসা তাদের জীবনের এ এক নিদারুন ট্রাজেডি। নিজ গৃহ থেকেও পরবাসী হতে হয় তাদের। তাই ঐ এলাকার দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থানের একমাত্র পথ হলো বড়বুচি নালাটি সংস্কার করে এর খোয়াই নদীর অংশে একটি ওয়াটার রেগুরেটর নির্মান করা। কারন এ খালটি ছাড়া জমির পানি নিষ্কাশন কিংবা শুষ্ক মৌসুমে সেচের কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
এলজিইডি’র ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের মনোনীত বিশেষজ্ঞদের সাথে ২০১৯ সনের ১৩-১৪ ডিসেম্বর মাসে সরেজমিন সমীক্ষায় দেখা যায়, খালটি সংস্কার বিহীন ভাবে মধ্যখানে ৩০-৫০ ফুট, নীচে ১০-১৫ ফুট এবং উপরের দিকে জরাজীর্ণ হয়ে ১০-২০ ফুট আকার ধারণ করে এর নাব্যতা হারিয়েছে। বড়বুচি নালার পাড়ের কৃষকদের মধ্যে ৪১% ক্ষুদ্র কৃষক, ২৩% প্রান্তিক কৃষক, ২০% মধ্যম কৃষক আর ১১% ভূমিহীন মানুষ। এদের আয় রোজগারের একমাত্র অবলম্বন কৃষি আর গায় গতরে খেটে শ্রম বিক্রি করা। মৌসুমী পাহাড়ী ঢলে জমে থাকা পানি যাওয়ার কোন বিকল্প রাস্তা না থাকায় তাদের ৫০% রোপা আমন এবং ৬০% আউশ ধানের ফলন প্রতি বছরই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
নভেম্বর মাসের শেষে খালটি পুরো শুকিয়ে যায়। সেচের জন্য মোটেও পানি থাকে না। সবজি ভান্ডার বলে খ্যাত চুনারুঘাটের চালবন্দ মাঠে তারা সবজি ফলাতে পারছেন না। এতে তাদের আয়ের অন্যতম উৎস আটকে আছে। বোরো ধানের ফলনও লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে হচ্ছে না। উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রীড জাতের ফলন কমে যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যের সবজি টমেটু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, ঝিংগা, চিচিংগা, চালকুমড়া ইত্যাদি ফলাতে পারছেন না। ফলে তারা দিন দিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছেন। এমন কি জীবনমান উন্নয়নের জন্য তারা হাঁসের খামার, উচ্চ মূল্যের সবজি চাষ, বসতবাড়ীর ভিটায় সবজি ও ফলজ বৃক্ষ রোপন না করতে পারায় মহিলারাও স্বাবলম্বী হতে পারছেন না। তাই প্রস্তাবিত প্রকল্পটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত বাস্তবায়ন করে শত শত গরীব গ্রামবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনে এলজিইডি’র ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প দ্রুত এগিয়ে আসবেন, চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি ইউনিয়ন বাসীর এটাই প্রত্যাশা।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *