বদরুল আলম ॥ একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর। রাতের অন্ধকার শেষে সবেমাত্র পূর্ব দিগন্তে সূর্য উকি দিয়েছে। কৃষ্ণপুর গ্রামের সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দৈনন্দিন কর্মকান্ডের। ঠিক তখনই হানা দেয় পাকিস্তানী সেনারা। ১৩১ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। সেদিন লাশের স্তুপ পড়েছিল কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে। সেই ভয়াল স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন মারা যাওয়ার ভান করে বেঁচে থাকা কয়েকজন।
লাখাই উপজেলার প্রত্যন্ত এ গ্রামে ঐদিন সকাল থেকে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞ চলে বিকেল চারটা পর্যন্ত। পুড়িয়ে ফেলা হয় ঘর-বাড়ি। পাক সেনারা পাশবিক নির্যাতন চালায় নারীদের উপরও।
ভোরে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থেকে একটি স্পিডবোট ও ৮/১০টি বাওয়ালী নৌকায় করে হানাদার বাহিনী কৃষ্ণপুরে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় মোড়াকরি গ্রামের লিয়াকত আলী, বাদশা মিয়া, ফান্দাউকের আহাদ মিয়া, বল্টু মিয়া, কিশোরগঞ্জের লাল খাঁ, রজব আলী, সন্তোষপুর গ্রামের মোর্শেদ কামাল ওরফে শিশু মিয়াসহ অন্তত ৫০ রাজাকার।
সেদিন পাকিন্তানি বাহিনী অন্তত ১৩১ জন পুরুষকে স্থানীয় কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। পরে, আগুন দিয়ে গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ও লুটপাট করে। এছাড়া গ্রামের অনেক নিরীহ নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। সকাল থেকে শুরু হওয়া এ হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ পুকুরে কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নেন। কয়েকজন পড়ে থাকেন মৃতের ভান ধরে। হানাদাররা চলে গেলে মরদেহগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেন তারা। কপালগুণে প্রাণে রক্ষা পান গোপাল রায়, প্রমোদ রায়, নবদ্বীপ রায়, হরিদাস রায় ও মন্টু রায়সহ আরও কয়েকজন।
বেঁচে যাওয়া গোপাল রায় বলেন, তখন তিনি ছিলেন টগবগে তরুণ আর ব্যবসায়ী। সকালে সহকর্মীদের নিয়ে পসারী দোকানের মালামালসহ লাখাই উপজেলার মাদনা গ্রামে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখেন, একজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে পাঞ্জাবীরা। সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড় দেন, তবে পালাতে পারেননি। তিনিসহ ধরা পড়েন অন্তত ১৭ জন।
গোপাল রায় আরো বলেন, আমাদের হাত পেছন দিয়ে বেঁধে নিয়ে ডাউন করিয়ে রাখে পাকিস্তানি সেনারা। মুহূর্তেই ব্রাশ ফায়ার। আমি গুলি লাগার আগেই দ্রুত মাটিতে লুটিয়ে পড়ি ও মরার ভান ধরে অনেকক্ষণ ধরে পড়ে থাকি। পরে পাকিস্তানিরা চলে গেলে মরদেহের স্তুপের উপর দিয়ে পালিয়ে যাই। সেদিনের কথা এখনো ভুলতে পারি না।
কৃষ্ণপুর গণহত্যা দিবসের ৪৯ বছর পুর্তি আজ। বিকেল চারটায় সেদিন মারা যাওয়াদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বধ্যভূমির উপর নবনির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন করবেন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির। এ সময় লাখাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুশফিউল আলম আজাদ ও উপজেলা নির্বাহী (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজংসহ অন্যান্যরা উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।