শাহ ফখরুজ্জামান॥ যে কোন দম্পত্তির চরম পাওয়া বা আনন্দের বিষয় হল সন্তানের জন্মদান। অনেক দম্পত্তির যথা সময়ে সন্তান না হলে কি পরিমাণ টেনশনে পড়ে যান এবং ডাক্তারের কাছে দৌড়ান তা ভুক্তভোগীরাই ভাল জানেন। আবার অনেকে দম্পত্তির সন্তান জন্মদানের পর শিশুর অসুস্থতা বা শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর ঘটনায় কি পরিমাণ বেদনাহত হন তাও অনেকেই দেখেছি। বানিয়াচং উপজেলার মুরাদপুর গ্রামে ৪ বছর পূর্বে জোড়া লাগা শিশুর জন্ম দিয়ে এক দরিদ্র দম্পত্তি কি পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তাও আমরা দেখেছি। পরে শিশু দুটির দুঃখজনক মৃত্যু হয়। তবে এ বছর শিশুর জন্ম নিয়ে হবিগঞ্জে তিনটি ঘটনা ঘটেছে। তিনটি ঘটনাই আনন্দের। তবে এই আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ্য হতে পারেনি তিন দরিদ্র দম্পত্তির। তিনটি ঘটনা হল এক সাথে তিন সন্তানের জন্মদান। এর মাঝে দুটি ক্ষেত্রে হয় স্বাভাবিক জন্ম এবং একটি হয় সিজার অপারেশনের মাধ্যমে।
গত বছরের শেষ দিকে হবিগঞ্জ মাতৃমঙ্গলে চুনারুঘাট উপজেলার বাগবাড়ী গ্রামের রিক্সা চালক জুবায়ের এর স্ত্রী মিনা এক সাথে জন্ম দেয় তিন ছেলে সন্তান। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে দৌড়াদৌড়ি করে যখন সিজার ছাড়া হবে না বলে ডাক্তাররা জানিয়ে দেয় তখন টাকার অভাবে তারা যায় মাতৃমঙ্গলে। সেখানকার নার্স নাদিয়া আক্তার নদীর প্রচেষ্টায় হয় নরমাল ডেলিভারী। তিন সন্তান ইয়াসির, আরাফাত ও সালমানের ওজন হয় কম। তাদেরকে চিকিৎসা করানোর মত অর্থ না থাকায় জুবায়ের তাদেরকে নিয়ে যায় বাড়ীতে। পরে আমি খবরটি জানতে পেরে চিকিৎসা করানোর জন্য খবর দিয়ে নিয়ে আসি হবিগঞ্জ হাসপাতালে। হাসপাতালে আসার পর ডাক্তাররা চিকিৎসা করান। আর তিন বাচ্চাকে পর্যাপ্ত বুকের দুধ দিতে পারবে সেই শারিরিক অবস্থা দরিদ্র গৃহবধু মিনার না থাকায় ডাক্তার সাপ্লিমেন্টারী দুধ খাওয়াতে বলেন। একটি দুধের কৌটার দাম ৮শ টাকা। ৪/৫ দিন যাবে এক কৌটায়। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে জুবায়েরের। তার উপর তিন শিশুকে কোলে নিতে ও যতœ দিতে প্রয়োজন তিনজন মহিলার। তাদেরও খাওয়ার খরচ আছে। পরে বিভিন্ন লোকজনের সহায়তায় জুবায়েরের তিন সন্তান সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে।
করোনাকালে হবিগঞ্জ শহরের সেন্ট্রাল হাসপাতালে গত ১২ জুন নবীগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের গৃহবধু রেখা আক্তার সিজারের মাধ্যমে জন্ম দেন তিন পুত্র সন্তান। রেখা আক্তারের স্বামী দিন মজুর আব্দুল বাছেত। কষ্ট করে সিজারের টাকা সংগ্রহ করলেও সন্তানের লালন পালন ও চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ দুঃসাধ্য হলেও আল্লাহই তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করবেন এই কথা বলে বাড়ী ফিরেন তারা। তাদের শিশু বিশেষজ্ঞ দেখানোর পরামর্শ দেওয়া হলেও টাকা না থাকায় তারা ডাক্তার না দেখিয়েই বাড়ীতে যান। পরে খোজ নিয়ে জানতে পারি আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় তিন শিশুই ভাল ও সুস্থ আছে।
সর্বশেষ গত ১৮ আগস্ট মাধবুপর উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে অস্ত্রোপচার ছাড়াই এক সঙ্গে তিন কণ্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন রহিমা বেগম নামে এক নারী। উপজেলার শিয়ালউড়ি গ্রামের আব্দুস সালামের স্ত্রী রহিমা বেগম এর আগেও এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। খবর নিয়ে জানতে পারি আব্দুস সালামও খুবই গরীব। তার তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তানটির ওজন এক কেজি ৫০০ গ্রাম, দ্বিতীয় সন্তানটির ওজন এককেজি ৭০০ গ্রাম ও তৃতীয় সন্তানটির ওজন এককেজি ৩০০ গ্রাম। তাদের শিশু বিশেষজ্ঞ দেখানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু টাকা না থাকায় তারা ডাক্তার দেখাতে পারেননি। মহিলাটি দরিদ্র হওয়ার কারণে কোনো হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে চলে গেছে।
উপরের তিনটি ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায় সবগুলো ঘটনা ঘটেছে দরিদ্র পরিবারে। আমরা মিডিয়া কর্মী হিসাবে সংবাদগুলো পরিবেশন করলে সবাই চমৎকৃত হন। সবাই মনে করেন এটি একটি আনন্দের সংবাদ। যাদের এক সাথে তিনটি সন্তান জন্ম হয়েছে তারাও সৌভাগ্যবান।
নিঃসন্দেহে এই ঘটনাগুলো আনন্দের এবং আল্লাহর অশেষ নিয়ামত। তবে এর পিছনে যে লুকায়িত সত্য এবং মানবিক কষ্ট আছে তা কেউ চিন্তা বা উপলব্ধি করতে পারেন না। কারন একজন মায়ের পক্ষে একটি শিশুর পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাওয়া যেখানে কষ্টসাধ্য সেখানে অপুষ্টিতে ভোগা দরিদ্র মায়ের পক্ষে এক সাথে তিন সন্তানকে বুকের দুধ দেয়া যে অসাধ্য তা সহজেই অনুমেয়। আবার কৌটার দুধের যে দাম তাও ক্রয় করার সাধ্যের বাহিরে। শুরুতে বয়স কম থাকায় এক কৌটা দুধে ৪/৫ দিন গেলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে দুধের পরিমাণ বাড়াতে হয়। এভাবে ৬ মাসে প্রচুর টাকা প্রয়োজন। আবার তিনটি শিশুর সেবা যতœ এবং ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে তিনজন নারীর সম্পৃক্ততা থাকতে হয়। সেখানে খরচের বিষয় জড়িত। এর বাহিরে তাদের অন্যান্য পরিচর্যা খরচ ত রয়েছেই। কিন্তু জোড়া লাগা শিশুর চিকিৎসা বা অসুস্থ লোকের পাশে দাড়ানোর জন্য আমরা বিভিবœ সময় অনেককেই এগিয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু এভাবে তিন শিশু বা অধিক শিশু জন্মের পরে তাদেরকে বাচিয়ে রাখতে যে সহযোগিতার প্রয়োজন তা নিয়ে আমরা কেউই চিন্তা করছি না। আর ঘটনাগুলো দরিদ্র পরিবারের ঘটায় তারাও সেভাবে বিষয়টি তুলে ধরতে পারছেন না।
সরকার দরিদ্র মায়েদের জন্য ল্যাকটেটিং মাদার প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পে সহায়তা প্রদান করে থাকে। এটি একটি ভাল উদ্যোগ। এর বাহিরেও সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে দেশের অসহায় মানুষগুলো আশ্রয় খুজে পায়। কিন্তু আমাদের সমাজে এ ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী যে ঘটনাগুলো ঘটছে তার জন্য নেই কোন বিশেষ কর্মসূচি। অথচ চাইলেই প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ এ ধরনের কেইসকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে তাদের পাশে থাকতে পারে। এর জন্য সরকারের আলাদা কোন প্রকল্পের প্রয়োজন নেই। কারন এগুলো নিয়মিত হচ্ছে না। এক বছরে হবিগঞ্জে হয়েছে তিনটি ঘটনা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে গত ৫ বছরের মাঝেই হয়ত এই তিনটি ঘটনাই ঘটেছে। আর এ ধরনের ঘটনায় নুন্যতম ৬ মাস পর্যন্ত পাশে থাকলেই বিপদমুক্ত হতে পারে জন্ম নেয়া শিশুগুলো। আর স্বাভাবিক বিকাশ এবং পুষ্টির চাহিদা পূরণে ২ বছর পর্যন্ত পাশে থাকলে অন্য শিশুদের মত স্বাভাবিক বেড়ে উঠা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সর্বশেষ মাধবপুর উপজেলায় যে তিনটি শিশুর জন্ম হয়েছে তাদের পরিবার শিশুদের চিকিৎসা ও খাবার সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে। আব্দুস সালাম ও রহিমা বেগম এ ব্যাপারে সহায়তা কামনা করেছেন। সরকারের পাশাপাশি ব্যাক্তিগতভাবেও যদি কেউ এগিয়ে আসেন তাহলে ফুটফুটে তিনটি কণ্যা সন্তানের বেড়ে উঠা নিশ্চিত হবে। তাই আসুন আমরা ওই তিন সন্তানের বেড়ে উঠায় সহায়তা করি এবং তাদের পাশে দাড়াই। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের বিষয়েও যেন একটু আলাদা নজর দেই।
লেখক
সাংবাদিক ও আইনজীবী