পাকিস্তানী শাসনামলে, আমাদের শৈশবে, দুর্গাপুজোর ছুটিতে শহর-হবিগঞ্জে তাঁর পৈত্রিক বাড়ীতে ‘কর্ণেল দত্ত কাকা’ তৎকালীন পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসতেন। আমাদের এই ‘কর্ণেল দত্ত কাকা’ ছিলেন কর্ণেল চিত্তরঞ্জন দত্ত সংক্ষেপে সিআর দত্ত। আমি যখন কর্ণেল সিআর দত্তকে প্রথম দেখি, তখন বুঝিনি যে তিনি বাঙালী। সম্ভবতঃ ১৯৭০ সালে দুর্গাপুজোর ছুটিতে তিনি যখন তাঁর ছেলে-মেয়ে-সহ আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন, তাঁদের সাথে তিনি উর্দুতেই কথা বলছিলেন। তাঁর ও তাঁর ছেলে-মেয়ের গাত্রবর্ণ, উচ্চতা ও ভাষা লক্ষ করে আমার মতো অনভিজ্ঞ ও বিস্মিত কিশোরের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব ছিলো না যে তিনি বাঙালী। শুনে ছিলাম, সিআর দত্ত ১৯৬৫ সালে পাক-ভারতের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্যতম বাঙালী বীর হিসেবে সম্মানিত হয়েছিলেন। তাই, তিনি তাঁর নিজ শহর হবিগঞ্জে এলে, স্থানীয় প্রশাসন-সহ সকলেই তাঁকে বিশেষ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো। কিন্তু তিনি টিপিক্যাল ‘হবিগঞ্জী আড্ডা’ দিতেন তাঁর অতি-সাধারণ বাল্যবন্ধুদের মধ্যে। আমার গৃহশিক্ষক মনি বাবুর কাছে শুনেছিলাম, সিআর দত্তের বাল্যবন্ধুদের মধ্যে লালমিয়া নামের এক ব্যক্তি পরবর্তীতে ‘লাল্ওয়া চোরা’ নামে কুখ্যাতি লাভ করে। পেশাগত কারণে, লাল মিয়াকে সদা-পলাতক থাকতে হলেও, কর্ণেল সিআর দত্ত ছুটি-ছাটায় বাড়ী এলে সেই লাল মিয়াকেই তখন বুক ফুলিয়ে কর্ণেল দত্তর সঙ্গে চলতে দেখা যেতো। এ পরিস্থতিতে পুলিসের সাহস হতো না লাল মিয়ার গায়ে হাত দেওয়ার। উপরের গল্পের নৈতিক-বার্তা হচ্ছে এই যে, সিআর দত্ত পাকিস্তানী সেনবাহিনীর ডাকসাঁইটে কর্ণেল হওয়া সত্ত্বেও নিজ শহরে তিনি ছেলেবেলার সেই চিত্ত হয়েই চলতেন তাঁর বাল্যবন্ধুদের সাথে। এটি হচ্ছে প্রকৃত বড়ো মানুষদের একটি বৈশিষ্ট্য। সিআর দত্ত ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারতের বিভক্তি-কালে ভারতীয় বাহিনীতে যোগ না দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যোগ দেন। হিন্দু-ধর্মীয় পটভূমির কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাঁর পদোন্নতি অতি সহজ ছিলো না, কিন্তু ১৯৬৫ সালের পাক-ভারতের যুদ্ধে তাঁর অসামান্য ভূমিকার জন্যেই তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর-কালে সিআর দত্ত ছুটিতে হবিগঞ্জেই ছিলেন। আর, হবিগঞ্জ ছিলো মুক্তিবাহিনীর জন্মভূমি। ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়াতে মুক্তিবাহিনীর জন্ম হয় মুক্তিফৌজ নামে। মুক্তিবাহিনীর জন্মদাতা সামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ কর্ণেল আব্দুর রব ও ৪ নং সেক্টরের কমান্ডার কর্ণেল সিআর দত্ত ছিলেন হবিগঞ্জের। এখানে হবিগঞ্জ কমান্ডেণ্ট মানিক চৌধুরীর নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পর সিআর দত্ত বীরউত্তমকে বাংলাদেশ রাইফেলস্ (বিডিআর) গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিআর দত্ত বীরউত্তম ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহাপরিচালক। মেজর জেনারেল হিসবে অবসর গ্রহণের পর সিআর দত্ত নানা বেসামরিক দায়িত্ব পালন করেন সম্মানের সাথে। সিআর দত্ত নিঃসন্দেহে একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক ছিলেন এবং দেশের জন্যে জীবনপণ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন।
আজ স্বদেশ থেকে বহু হাজার মাইল দূরে পার্থিব সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেলেন বাংলার এক অসামান্য বীরসন্তান চিত্তরঞ্জন দত্ত। তাঁর অন্তিম-মুহূর্তে তিনি হয়তো শিউলি ঝরা ও শিশির স্নাত বাংলার পাখীডাকা ভোরের কথা স্মরণ করে থাকবেন। অন্তিম মুহূর্তে সিআর দত্ত হয়তো তিনি তাঁর শৈশবের শহর হবিগঞ্জের কথা স্মরণ করে থাকবেন। আমি নিশ্চিত যে, হবিগঞ্জও আজ অশ্রুসিক্ত হয়ে স্মরণ করছে তাঁর বীর পুত্র চিত্তকে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই বাঙালী বীরের মরদেহ তাঁর যুদ্ধে-জেতা বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে যথাযোগ্য মর্য্যাদার সাথে তাঁর প্রিয় হবিগঞ্জে সমাহিত করা।
মাসুদ রানা
শিক্ষক ও লেখক