অধ্যাপক ড.জহিরুল হক শাকিল ॥ ডান দিকে যতশূন্যই দেয়া হোক যদি বামে শূন্য ব্যতিত কোনো সংখ্যা না থাকে তাহলে এর কোনো মূল্য নেই। বামে শূন্য ব্যতিত কোনো সংখ্যা ছাড়া এক শূন্য যা এক কোটি শূন্যও তা। বলছিলাম হবিগঞ্জ পৌরসভার নাগরিক সেবা নিয়ে। মার্চ থেকে করোনা সংকটে লকডাউন থাকায় সারা দেশের ন্যায় পৌরসভার উন্নয়ন কার্যক্রমও থমকে দাঁড়ায়। হবিগঞ্জ পৌরসভার দু একটি এলাকা বাদ দিলে মনে হবে এ যেন এক পরিত্যক্ত নগরী। আর এ অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের জঞ্জালের ফলাফল হলো আজকের ড্রেনেজ সমস্যা। যার জন্য পানি নিষ্কাশনের সমস্যা। ফলাফল জলাবদ্ধতা। অপরদিকে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হবিগঞ্জ পৌরসভার ইতিহাসে কখনই ছিল না।
তারপরও পৌরসভার সীমানা দিন দিন বাড়ছে। জনসংখ্যা বাড়ছে। এখানে স্কুল-কলেজসহ প্রশাসনিক কার্যক্রমের আওতা ও ব্যাপকতা বাড়ার পাশাপাশি জেলা শহরের সাথে হবিগঞ্জের সবকটি উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলার যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপিত হওয়ায় জেলা শহরের পৌরসভা হিসেবে চাপ বেড়েছে গত এক দশকে কয়েকগুণ। কিন্তু পৌরসভার সক্ষমতা সে অনুযায়ী বেড়েছে বলে মনে হয় না। তবে অবশ্যই পৌরসভার আভ্যন্তরীন আয় বেড়েছে। সরকারি বরাদ্দও বেড়েছে।
আমি পৌরসভার সার্বিক কার্যক্রমের উপর জোর দিচ্ছি না। এ মুহুর্তে পৌরসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কাজ হচ্ছে বর্জ্য সমস্যার একটি সমাধানের পথ খোঁজে বের করা। তা না হলে যত কর্মতৎপরতাই দেখান সেগুলো বামপাশে সংখ্যা ছাড়া ডান পাশের শূন্যের ন্যায় অর্থহীন, অহেতুক, মূল্যহীন।
এক সময় হবিগঞ্জের যেখানে পৌর বাস টার্মিনাল সেখানে ময়লা ফেলা হতো। সেজন্য এ স্থানটি ময়লার চক্কা নামে পরিচিত ছিল। পরে সেই ময়লার চক্কা ও আশে পাশে জমি অধিগ্রহন করে পৌর বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। যদিও এটি অনেক বছর অবব্যবহৃত ছিল। শেষ পর্যন্ত শহরের জে কে এন্ড এইচ কে হাই স্কুলের ভাড়া করা মাঠ থেকে বাসস্ট্যান্ড স্থানান্তরিত হলো। কিন্তু সেখানেই ছিল গলদ। বাসটার্মিনাল নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহনের সময়ই ময়লার স্থান ফেলার জন্য একটি সংস্থান করা প্রয়োজন ছিল। সেটা না করাতেই আজকের সমস্যা। যা যত দিন যাবে সমস্যা তত প্রকট হবে। এক সময় আজকের আধুনিক স্টেডিয়াম সংলগ্ন বাইপাস রোডের ন্যায় সারা পৌরসভাই ময়লার ভাগারে পরিণত হবে। হবিগঞ্জ শহরে করোনায় কতজন মারা গেছে? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি পৌরসভার ময়লা আবর্জনা থেকে সৃষ্ট রোগে অনেক মানুষ মারা যাবে, অনেকে অসুস্থ হবে, নাগরিকদের চিকিৎসা ব্যয় বাড়বে। প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর ব্যবসা জমজমাট হবে। সেই ক্লিনিকে আরো বেশি অস্ত্রোপাচার বা অপারেশন হবে। আরো বেশি রক্ত পূজ, ব্যান্ডেজ, রক্তভেজা গেজ, সিরিঞ্জের সূচ, অপারেশনের পর কেটে ফেলা পচা মাংসপিন্ড সবই আবার বর্জ হিসেবে এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে পড়বে। বাতাস ও পানির সাথে মিশে আবার তা মানব দেহে যাবে। আবার মানুষ অসুস্থ হবে। এ চক্র থেকে নাগরিকদের মুক্তি নেই। রান্না-বান্না থেকে সৃষ্ট ময়লা আবর্জনা আর হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ময়লা আবর্জনা এক নয়। হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোকে হয় তাদের বর্জ্য নিজস্ব উদ্যোগে রিসাইক্লিন করে ফেলতে বাধ্য করেন। অথবা তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক ব্যবস্থা করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ সালে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের’ সঙ্গে হাসপাতালের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য চুক্তি করে। সে অনুযায়ী প্রিজম ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরের চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশনের কাজ করছে। এ ধরনের আরো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এগুলোর সাথে আলাপ করে চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহন করা প্রয়োজন। এরজন্য যা ব্যয় হবে তা হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো থেকে আনুপাতিকহারে আদায় করে নেয়া যাবে। সিলেট সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। সেই অভিজ্ঞতা নিতে পৌরসভার মেয়র ও সকল কাউন্সিলর একবার সিলেট সফর করে আসতে পারেন।
যাই হোক, কয়েক বছর পূর্বে পৌরসভা হবিগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের পাশে ভূমি ক্রয় করেছিল ডাম্পিং স্টেশন তৈরী করতে। জমির রেজিস্ট্রেশনও নাকি সম্পন্ন হয়। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের প্রতিবাদে সেটা করা সম্ভব হয়নি। আর নৈতিকতার প্রশ্নে পৌরসভা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর পেছনে রাজনীতি যাই থাকুক না কেন একটি সহজ প্রশ্ন ছিল পৌরসভার ময়লার দায় পৌরসভার বাইরের এমনকি সদর উপজেলার বাইরের জনগণ নিবে কেন। যার জন্য বিরাট কোনো আন্দোলন বা প্রতিবাদ না হওয়া সত্ত্বেও পৌরসভা তাদের অর্থে ক্রয় করা ভূমিতে ডাম্পিং স্টেশন করতে পারেনি।
আসলে ভূত তাড়াতে হয় শর্ষে দিয়ে। কিন্তু শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তো সমস্যা। পাগলকে বাধতে হয় রশি দিয়ে। কিন্তু রশিই যদি পাগল হয়ে যায়! পৌরসভা দেখভাল করবে নাগরিকরা যাতে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা না ফেলে। অথচ পৌরসভাই শহরের সকল ময়লা সংগ্রহ করে আধুনিক স্টেডিয়াম ও আনসার অফিস সংলগ্ন বাইপাস সড়কের খালে ফেলছে। পৌরসভার অনেক কাজের মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজ হলো সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যমে পরিবেশ নির্মল রাখা। পৌরসভাকে সকলের জন্য বাসযোগ্য করা।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ যা ২০০৯ সনের ৫৮নং আইন নামে পরিচিত। সেখানের ধারা ২ এর উপ-ধারা (১) এ বলা হয়েছে অনেকগুলো কাজের মধ্যে পৌরসভার প্রথম তিনটি কাজ হবে (ক) আবাসিক, শিল্প এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য পানি সরবরাহ; (খ) পানি ও পয়ঃ নিষ্কাশন ও (গ) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। আবর্জনা পরিস্কার করে পৌর এলাকাকে বাসযোগ্য করে তোলা হলো পৌরসভার অন্যতম প্রধান কাজ। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এ ‘আবর্জনা’ অর্থ জঞ্জাল, উচ্ছিষ্ট, বিষ্ঠা-ময়লাদি, জীব-জন্তুর মৃতদেহ, নর্দমার তলানি, পয়ঃপ্রণালীর থিতানো বস্তু ময়লার স্তুপ, বর্জ্য এবং অন্য যে কোন দূষিত পদার্থ।
হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান যে একজন কর্মঠ, একনিষ্ঠ ও নাগরিক সেবা দিতে তৎপর তা অস্বীকার করার নয়। তার সময়কাল খুবই অল্প। তারপরও করোনা সংকট মোকাবেলায় সদা তৎপর ছিলেন মেয়র। বর্ষায় জলাবদ্ধতা মোকাবেলায়ও তার কর্মতৎপরতা ও আন্তরিকতার ঘাটতি ছিলো না। মেয়র এক বছর পূর্বে বলেছিলেন উমেদনগরে পৌরসভার সীমানার মধ্যেই স্মার্ট ডাম্পিং স্টেশন হবে। যা থেকে গন্ধ ছড়াবে না। জনগনেরও দুর্ভোগ হবে না। মানুষের বাহবা পেয়েছিলেন। কিন্তু একাজটির অগ্রগতি কী তা জনগন এখনও জানেন না। অচিরেই এর সমাধান জনগণ চাচ্ছেন।
পৌর কর্তৃপক্ষ বিশেষত মেয়র মিজানুর রহমানের এ মূহুর্তে মূল কাজ হলো পৌর এলাকাকে আবর্জনামুক্ত করা। আধুনিক স্টেডিয়াম সংলগ্ন বাইপাস খাল ছাড়াও শহরে অন্ততঃ একশত আবর্জনা স্পট রয়েছে। এসবের একটি কার্যকরী সমাধান বের করা। প্রতিটি নাগরিকের নির্মল পরিবেশে শ্বাস নেয়ার অধিকারটুকু পৌর কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে দিবে এটাই আজকের গণদাবী।