বদরুল আলম ॥ ‘পাড়ার মানুষ কয় কেল্লাইগ্যা পোলারে মিছিলে ফাডাইছলায়? আমি তাঁরারে কইয়্যা দিছি আমার পোলা শহীদ অইছে’ কথা দুটি উচ্চারণ শেষে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাহমুদা বেগম। চিৎকার শোনে পাড়ার কয়েকজন এগিয়ে এলে তিনি মৃত ছেলের কাপড়চোপড় হাতে নিয়ে বিলাপ করতে থাকেন।
জরাজীর্ণ ঘরের মেঝেতে দুই হাত ছাপড়িয়ে বলতে থাকেন ‘যাওয়ার সময় কইয়্যা গেছে রাইতে আমার লাগি লাকড়ি আর জিয়ল মাছ (শিং, মাগুড়) লইয়্যা বাড়িত আইব। এরপরে খবর ফাইলাম পোলা আমার গুলি খাইয়্যা মারা গেছে। ও আল্লাহ আমার একি সর্বনাশ অইলো গো।’
মিনিট দশেক ধরে চলতে থাকা মাহমুদা বেগমের বিলাপ শোনে আরও লোকজন এগিয়ে এসে তাকে শান্তনা দেন। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে বানিয়াচংয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত আশরাফুল ইসলামের (১৭) বাড়িতে গেলে এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখা যায়।
বানিয়াচং উপজেলায় জাতুকর্ণপাড়া ডুগিহাটির আব্দুর রউফের ছেলে আশরাফুল মাত্র ১৩ বছর বয়সে কাঠমিস্ত্রীর কাজে যোগ দিয়ে পরিবার চালানোর দায়িত্ব কাঁধে নেয়। চার ভাইবোনের লেখাপড়া, চিকিৎসা ও সংসার চালানোর ব্যয় এ সবকিছুর ব্যয়ভার ছিল আশরাফুলের উপরেই।
গ্যানিংগঞ্জ বাজারে একটি ফার্নিচারের দোকানে মাসিক ১২ হাজার টাকা সম্মানিতে কাজ করা আশরাফুল ছয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। তাঁরা চার বোন ও দুই ভাই।
বড় বোন লোবনা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। এর পরের জন রোজমা আক্তার শায়েস্তাগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে ও তৃতীয় বোন তাইমা আক্তার বৃন্দাবন সরকারি কলেজে স্নাতকে লেখাপড়া করছেন। আশরাফুলের ছোট তৈয়বা আক্তর দশম শ্রেণি ও সবার ছোট আব্দুর রকিব অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। তাঁদের সবার লেখাপড়া, চিকিৎসা ও সংসার চালানোর ব্যয় নির্বাহ হতো আশরাফুলের রোজগার দিয়েই।
তার মা মাহমুদা বেগম জানান, আশরাফুল প্রতিদিন সকালে কাজে গিয়ে রাতে বাড়ি ফিরেন। গত ৫ আগস্টও নিয়মমত বের হয়েছিলেন। পরে কর্মস্থল থেকে বন্ধুদের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার মিছিলে যোগ দেয়। এক বন্ধু মিছিল থেকে তাঁকে ফেরৎ আসার জন্যও অনুরোধ করেছিল, কিন্তু আশরাফুল আসেনি। এরপর পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়।
তাঁর সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, আশরাফুলের বাবা দ্বিতীয় সংসার করেছেন। তার পক্ষে সবার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অপরিণত বয়সের আশরাফুলই শ্রমঘামে তার পাঁচ ভাই বোনকে আগলে রেখেছিল। তার চলে যাওয়ায় পর পাঁচ ভাই বোনের লেখাপড়া অনিশ্চিত। ছেলে হত্যাকান্ডের বিচার ও তাঁকে শহীদের মর্যাদা দিতে তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা যাওয়ায় সবার চোখে এখন শোক ও দুশ্চিন্তার ছাপ।
খোয়াইয়ের সঙ্গে কথা হলে ছোট বোন তৈয়বা আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই আমাদের মাথার উপরের ছায়া ছিল। আমরা তার হত্যার বিচার চাই।’
বানিয়াচংয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমন্বয়ক ডিএইচ রাজু বলেন, ‘আশরাফুলের পরিবার অতিশয় দরিদ্র। সে ‘শহীদ’ হওয়ায় পুরো পরিবার এখন অকুল পাথারে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকার এবং সমাজে বিত্তবানদের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।’
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট সকাল ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাগরদিঘীর পশ্চিমপাড় ঈদগাহ মাঠ থেকে মিছিল বের করে। গ্যানিংগঞ্জ বাজার প্রদক্ষিণ শেষে মিছিলকারী ৪/৫ হাজার লোক বড়বাজার শহীদ মিনারে গিয়ে জড়ো হন। পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন মিছিল নিয়ে থানার সামনে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের কথা কাটাকাটি হয়। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।
সেদিনের ঘটনায় নিহতরা হলেন, বানিয়াচং উপজেলায় খন্দকার মহল্লার মৃত আবুল হোসেনের ছেলে ও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র আনাস (১৪), পাড়াগাঁও গ্রামে শমশের মিয়ার ছেলে শ্রমজীবী মোজাক্কির মিয়া (৪০), কামালখানী গ্রামের রাজমিস্ত্রী নয়ন মিয়া (১৮), কমলারাণীর দিঘীর পূর্বপাড়ে মোশাহিদ আখঞ্জির ছেলে সাংবাদিক সোহেল আখঞ্জি (২৭), জাতুকর্ণপাড়া ডুগিহাটির আব্দুর রউফের ছেলে রঙমিস্ত্রী তোফাজ্জল মিয়া (২২), বটের হাটির আব্দুন নূরের ছেলে কাঠমিস্ত্রী আশরাফুল ইসলাম (১৭), পূবগড় গ্রামে ধলাই মিয়ার ছেলে পেশাজীবী সাদিকুর রহমান (৩০), কামালখানি মহল্লায় তাহির মিয়ার ছেলে পেশাজীবী আকিনুর মিয়া (৩৫), যাত্রাপাশা মহল্লায় সানু মিয়ার ছেলে হাসান মিয়া (১২) ও বানিয়াচং থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সন্তোষ রায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সময় পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে চারজনসহ সাতজন নিহত হন।
তখন চিত্র ধারণ করতে গেলে বিক্ষুব্ধরা এক সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা করে। মোট মৃতের সংখ্যা হয় আট। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা থানার উপপরিদর্শক সন্তোষকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরদিন গুলিবিদ্ধ আরেকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এরপর স্থানীয় লোকজন থানায় আক্রমণ করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন এবং পুলিশ সদস্যদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এরপর গত ১৫ আগস্ট ১২ জন পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে যোগ দেন। পরদিন থানা প্রাঙ্গণ থেকে ৬৬ রাউন্ড বন্দুকের গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।