স্টাফ রিপোর্টার ॥ বানিয়াচংয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলার আসামী কারা তা নিজেই জানেন না মামলার বাদী। যদিও নিহত অন্য আটজনের পরিবারের সম্মতি নিয়ে তিনি মামলাটি দায়ের করেন বলে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানতেন আন্দোলনকারী আটজনের মৃত্যু হয় ‘পুলিশের গুলিতে’। অথচ মামলায় কোন পুলিশ সদস্যকে আসামীভুক্ত না করায় এনিয়ে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
ছাত্রজনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিতে নিহত ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মোঃ হাসাইন মিয়ার বাবা মোঃ সানু মিয়া গত বৃহস্পতিবার বানিয়াচং থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
১৬০ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও দুই থেকে আড়াইশ’ জনকে আসামী করা এ মামলায় বলা হয়েছেÑ ছাত্র-জনতার মিছিলে তিন থেকে চারশ’ জন আওয়ামী সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে। আসামীদের ২৫ জনের ছোড়া গুলি ও ১২ জনের দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে নয় আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়।
এদিকেÑ ৫ আগস্ট দশজন নিহত হওয়ার ঘটনায় উত্তেজিত লোকজন বানিয়াচং থানায় অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশের গুলিতে আটজন নিহত হয়েছে দাবি করে পিটিয়ে হত্যা করা হয় থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সন্তোষ চৌধুরীকেও।
মামলা দায়েরের পর দেখা গেল কোন পুলিশ সদস্যকে এতে আসামী করা হয়নি। এনিয়ে নিহতদের পরিবারসহ স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।
মামলা দায়েরের আগে নিহত কাঠমিস্ত্রী আশরাফুল হত্যা মামলা দায়ের নিয়ে তাঁর দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ির লোকজনের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিয়েছিল বলে নিহতের মা মাহমুদা বেগম খোয়াইকে জানান।
তাঁর দাবিÑ আশরাফুলের মামারা বলছেন “আমাদের ভাগ্নে আট জনের সঙ্গে শহীদ হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা তাতে সম্মত।”
“আর দাদাবাড়ির লোকজন হত্যার সঙ্গে জড়িত নয় এমন লোককে আসামী দিতে চান” উল্লেখ করে মাহমুদা বেগম বলেন, ‘আমার বুকের ধনকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
আপনাদের সম্মতিতে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে কি না জানতে চাইলে আশরাফুলের মা জানান, তিনি শোনেছেন মামলা হয়েছে। তবে তাদের সম্মতি নেওয়া হয়নি বা কেউ তাঁর পরিবারের কোন সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। মামলা দায়েরের ঘটনায় তিনি হতবাক।
এদিকে মামলার বাদী সানু মিয়ার ভাষ্য ‘একে তো আমি আমার পোলা হারাইছি। আরেকবার মামলায় নিরপরাধ মানুষ ঢুকলে আমি আল্লাহর কাছে জবাব দিতাম পারতাম না।’
মামলায় কাদের আসামী করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি খোয়াইকে বলেন, ‘আমার পড়াশোনা জানা নেই। আমার ছেলেসহ অন্যদের যারা হত্যা করেছে তারাই মামলার আসামী হয়েছে জানিয়ে এজাহারে আমার স্বাক্ষর নেওয়া হয়। স্বাক্ষর করার আগে আসামীদের নাম ও কয়জন আসামী আমাকে পড়ে শোনানো হয়নি।’ মামলায় কোন পুলিশ সদস্যকে আসামী করা হয়নি জেনে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, ‘বানিয়াচংয়ে পুলিশের গুলিতে আটজন নিহতের ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোচিত। এলাকাবাসীর প্রত্যাশা ছিল শিশু, শ্রমিক ও ছাত্রদের মূল হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে। অথচ মামলায় গুলিবর্ষণকারী কোন পুলিশ সদস্যকে আসামী করা হয় নি। এতে সবাই আশ্চর্য্য ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।”
তাঁদের দাবি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য মামলায় প্রকৃত আসামীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট সকাল ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাগরদিঘীর পশ্চিমপাড় ঈদগাহ মাঠ থেকে মিছিল বের করে। গ্যানিংগঞ্জ বাজার প্রদক্ষিণ শেষে মিছিলকারী ৪/৫ হাজার লোক বড়বাজার শহীদ মিনারে গিয়ে জড়ো হন। পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন মিছিল নিয়ে থানার সামনে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের কথা কাটাকাটি হয়। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সময় পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে চারজনসহ সাতজন নিহত হন।
তখন চিত্র ধারণ করতে গেলে বিক্ষুব্ধরা এক সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা করে। মোট মৃতের সংখ্যা হয় আট। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা থানার উপপরিদর্শক সন্তোষকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরদিন গুলিবিদ্ধ আরেকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।