কেন বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি?

শেষ পাতা

শাহ ফখরুজ্জামান ॥ আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ছোট বড় অনেক ফৌজদারি অপরাধ হচ্ছে। এই অপরাধের কিছু কিছু ঘটনায় আদালতে মামলা হচ্ছে। আবার অনেক ঘটনা মামলার আগেই সালিশে নিষ্পত্তি হচ্ছে। আবার আদালতে মামলা হওয়ার পরও অনেকটা আপস হয়ে যাচ্ছে। মামলা যখন কগনিজেন্স বা আমলি আদালতে থাকে, তখন আসামিরা অপরাধের ধরন অনুযায়ী কারাভোগ করলেও অনেক মামলা শেষ পর্যন্ত পরিচালনা হয় না। আবার যে মামলাগুলো পরিচালিত হয় তার সবগুলোতে অপরাধ প্রমাণিত করা সম্ভব হয় না বলে অপরাধী যথাযথ শাস্তি পাচ্ছে না। অপরাধ প্রমাণে যথাযথ সাক্ষী, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, অভিযোগপত্র, অন্যান্য ডকুমেন্টস এবং আইনি যুক্তিতর্কের বিষয় জড়িত।
চাঞ্চল্যকর মামলা প্রমাণে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই জবানবন্দি আইনের দৃষ্টিতে সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী প্রমাণ হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু বাস্তবে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি নিয়ে নতুন নতুন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জজ মিয়া নাটকের পর কয়েকদিন আগে নারায়নগঞ্জের ঘটনায়ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি।
আমরা যারা মিডিয়াকর্মী হিসেবে কাজ করি এবং যখন জানতে পারি চাঞ্চল্যকর ঘটনার দায় স্বীকার করে গ্রেফতার হওয়া আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে, তখন ছুটে যাই সেই সংবাদ প্রকাশ করার জন্য। পরে ফলাও করে সেই সংবাদ প্রকাশ করি রহস্যের উদঘাটন হয়েছে বলে। আবার যেহেতু আইন পেশায় জড়িত রয়েছি, ১৬৪ ধারার অনেক জবানবন্দি নিয়ে দুঃখজনক গল্প শুনতে পাই। এই গল্পগুলো এমন, পুলিশ আসামিকে বলে ‘আমি তোকে যা শিখিয়ে দেব ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তা বললে তোকে ছেড়ে দেব’। গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল লোকজন এ কথা বিশ্বাস করে নিজে অপরাধ না করলেও অনেক সময় পুলিশের কথা সরল বিশ্বাসে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলে দেয়।
এই জবানবন্দি দেওয়ার পর যখন আসামি ভুল বুঝতে পারে, তখন আর কিছু করার থাকে না। তবে আমার অনেক সহকর্মীকে দেখেছি, পরে তারা একটি হলফনামা দিয়ে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেট তা আমলে নেন না। তখন আইনজীবীরা সেই আবেদনটি নথির সঙ্গে সামিল করে দিতে বলেন, যাতে করে বিচারের সময় বিষয়টিকে ডিফেন্স করতে পারেন।
আমার একটি মামলায় দেখেছি, এক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ব্যাপারে ভিকটিমের পরিবার মামলা করতে চাইলে প্রথমে থানা মামলা নেয়নি। পরে আমি এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করি। একটি মানবাধিকার সংস্থা বিষয়টি নিয়ে থানায় যোগাযোগ করলে পরে মামলাটি রেকর্ড হয়। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তিন আসামিকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু পরে আসামিদের রক্ষার জন্য শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। আমি জানতে পারি ধর্ষণের শিকার হওয়া কিশোরী ও তার মাকে চারদিন আটকে রেখে প্রলোভন দেওয়া হয়, ভিকটিমের ২২ ধারার জবানবন্দিতে যেন ওই তিন আসামির নাম না বলে যিনি ভিকটিমকে উদ্ধার করেছেন এবং যাকে মামলার সাক্ষী মানা হয়েছে, তিনি ধর্ষণ করেছেন বলা হয়। এতে করে ওই সাক্ষীর সঙ্গে কিশোরীর বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে এবং দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে। পাহাড়িরা সহজ-সরল হয়। আবার কিশোরীর বয়সও কম। ফলে সে সহজেই সেই প্রলোভনে পা দিয়ে ২২ ধারায় জবানবন্দিতে পুলিশের শেখানো কথাই বলে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।
অপরদিকে যিনি ধর্ষকের কাছ থেকে ভিকটিমকে উদ্ধার করেছেন, সেই ব্যক্তিকে পুলিশ আটকে নির্যাতন করে বাধ্য করেছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে তিনি নিজেই ধর্ষণ করেছেন সেই কথা বলাতে। পরে ভিকটিমের ২২ ধারায় জবানবন্দি এবং উদ্ধারকারীর ১৬৪ ধারার জবাবন্দি হুবহু একই হয়। আর সেই সুযোগে তিন ধর্ষণকারী জামিনে বের হয়ে আসে। কারাগারে আটকে আছেন সেই উদ্ধারকারী। বিষয়টি আমাকে ভিকটিম ও তার লোকজন বললে আমি দরখাস্ত দিয়ে আদালতের নজরে আনার চেষ্টা করি।
এবার আসা যাক নারায়ণগঞ্জের ঘটনার দিকে। সেখানে কিশোরীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে এমন স্বীকারোক্তি দেওয়া মামলার তিন আসামি কারাগারে বন্দি। কিন্তু ওই জবানবন্দি দেওয়ার ১৪ দিন পর ওই কিশোরীকে জীবিত উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর আগে গত ৪ জুলাই থেকে নিখোঁজ হয় নারায়ণগঞ্জ শহরের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। গত ১৭ জুলাই সদর মডেল থানায় জিডি করেন তার বাবা। এরপর ৬ আগস্ট থানায় অপহরণ মামলা করেন তিনি।
পুলিশ মেয়েটির মায়ের মোবাইলের কললিস্ট চেক করে রকিবের সন্ধান পায়। রকিবের মোবাইল নম্বর দিয়ে আব্দুল্লাহ কিশোরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এ ঘটনায় রকিব, আব্দুল্লাহ ও নৌকার মাঝি খলিলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন হোসেন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ূন কবিরের পৃথক আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন আসামিরা। স্বীকারোক্তিতে তারা জানান, কিশোরীকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীতে।
এ ধরনের স্বীকারোক্তির পর যখন ভিকটিম জীবন্ত উদ্ধার হয়, তখন ১৬৪ ধারার জবানবন্দি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। এর আগে জজ মিয়া নাটকও দেশবাসী দেখেছে। অথচ কোনো আসামি যখন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়, তখন বিচারের আগে তার জামিন পাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। কারণ বিজ্ঞ বিচারকরা ১৬৪ ধারার জবানবন্দি ও কিছু কিছু মামলায় আসামির আগের পিসিপিআর গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন এবং জামিন দিতে বিলম্ব করেন। শুধু তাই নয় ,কোনো আসামি যখন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে বড় ধরনের কোনো ঘটনার সাথে জড়িত কারও নাম প্রকাশ করে তখন তার নাম যদি মামলার
এজাহারে নাও থাকে সে আসামি হয়। স্বীকারোক্তিতে নাম থাকায় ওই আসামীর জামিন পাওয়াও কঠিন হয়।
ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬১ ধারায় সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেওয়া হয় যা জুডিশিয়াল রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হয় না। কিন্তু উক্ত আইনের ১৬৪ ধারা বলে কোনো জবানবন্দি বা স্বীকারোক্তি যদি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক গৃহীত হয়, তবে এটা জুডিশিয়াল রেকর্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় বিধায় বিচারামলে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ধারার অধীনে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি তার নিজের অপরাধের লিখিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে থাকেন একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। ১৬৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, যেকোনো মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা প্রথম শ্রেণির একজন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত দ্বিতীয় শ্রেণির একজন ম্যাজিস্ট্রেটের এই জবানবন্দি রেকর্ড করার ক্ষমতা রয়েছে এবং তা বিচার বা তদন্ত শুরু হওয়ার আগে বা পরে যেকোনো সময় হতে পারে।
এখন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আগে যিনি রেকর্ড করবেন, তিনি যে কাজগুলো করেন, সেগুলো হলো:

ক. স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কোনো পুলিশের সামনে রেকর্ড করা যাবে না, এটা অবশ্যই শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এবং তার তত্ত্বাবধানে রেকর্ড হবে, এমনকি এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষেও কোনো পুলিশ উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
খ. ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪(৩) ধারা মোতাবেক, সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আগে তিনি অবশ্যই জবানবন্দিদাতাকে এটা পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করবেন যে, এই জবানবন্দি দিতে তিনি কোনোভাবেই বাধ্য নন এবং তাকে এ-ও পরিষ্কার করে বলতে হবে যে, যদি এ ধরনের কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, তাহলে এটা তার বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে।
গ. সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দিদাতাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, এই জবানবন্দিদাতা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এবং কোনো প্রকার প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ঘ. ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড ও স্বাক্ষর করার যে পদ্ধতি বলা হয়েছে, সে মোতাবেক সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দিদাতার স্বাক্ষর নেবেন এবং স্বাক্ষর নেওয়ার আগে তিনি কী জবানবন্দি দিয়েছেন, তা তাকে অবশ্যই পড়ে শোনাবেন।
ঙ. এবং সর্বশেষ তিনি স্বীকারোক্তির শেষে সবকিছু উল্লেখ করেন, অর্থাৎ আইন দ্বারা আরোপিত দায়িত্বগুলো তিনি কীভাবে পালন করেছেন এবং তিনি কীভাবে আশ্বস্থ হয়েছেন যে, এই জবানবন্দি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি জবানবন্দি দেওয়ার ফলাফল সম্পর্কে ব্যক্তিকে অবহিত করেছেন কি-না ইত্যাদি উল্লেখ করে একটি মেমোরেন্ডাম লিখবেন, যেটা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির একেবারে শেষে থাকবে এবং ওই মেমোরেন্ডামের নিচে তিনি স্বাক্ষর করবেন।
সবকিছু মিলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য তদন্তকারীর রহস্য উদঘাটনের প্রচেষ্টাকে ২/১টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে বিচার না করে বরং ১৬৪ ধারা নিয়ে যেন কেউ প্রশ্ন না করতে পারেন, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সতর্ক ও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আর না হলে আদালতে জজ মিয়া নাটক আর নারায়ণগঞ্জের ঘটনাকে নজির হিসেবে উপস্থাপন করে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হবে। তাই বলছি, বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নই থাক আর সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচার পেতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দির প্রতি আস্থাশীল থাকুক এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখকঃ সাংবাদিক ও আইনজীবী

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *