ড. জহিরুল হক শাকিল ॥ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী প্রতিশব্দ ইউনিভার্সিটি। যা ল্যাটিন শব্দ ইউনিভার্সিতাস থেকে এসেছে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় মানেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যদিও ল্যাটিন শব্দ ইউনিভার্সিতাস এর সাথে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো মিল নেই। ইউনিভার্সিতাস বলতে বুঝায় সমিতি বা গিল্ড। ইউরোপে ইউনিভার্সিতাস বলতে পেশাজীবিদের সমিতি বুঝাতো। মধ্যযুগে ইউরোপে ছাত্র ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে সমিতি বা ইউনিভার্সিতাস গড়ে উঠে। প্রাচীন গ্রীসে ইউনিভার্সিটিকে একাডেমী বলা হতো। মধ্যযুগের ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বুঝানো হতো যেখানে ধর্মতত্ত্ব এবং ধর্ম পড়ানো হয়। বিশ্বের প্রাচীন ও সেরা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শুরুতে ছিল অনেকটা চার্চের মতো। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১০৯৬ সালে। এরচেয়েও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হলো মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়। যা স্থাপিত হয় ৯৭০ সালে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটাস পায় ১৯৬১ সালে। তবে জেনে আশ্চর্য হবেন যে বিশ্বের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কিন্তু আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে। তাও সম্পূর্ন আবাসিক। সেটা আমাদের খুবই নিকটে। ভারতের বিহারে। পঞ্চম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় সারা বিশ্বের জ্ঞান চর্চার পীঠস্থান ছিল। আমি যখন ২০১২ সালে বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে পিএইচডি গবেষনা শুরু করি তখন বারবার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেক্টের দিকে ফিরে যেতে হয়েছে। আমাদের একজন অধ্যাপক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ আসলেই আমাকে দেখিয়ে বলতেন, ওর বাড়ির কাছে। তখন সবাই আমার দিকে তাকাতো। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠতো। উইকিপিডিয়াতে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “আধুনিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা এক কথায় অপরিসীম ও বিস্তৃৃত এবং ব্যাপক। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, আর্ট, কলা, সামাজিক-বিজ্ঞানের বিস্তৃৃত বিষয়াদিসহ এক কথায় সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। একাডেমিক ডিসকোর্সে জ্ঞান জগতের বিস্তৃৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি।” তবে আমাদের দেশে ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বুঝানো হয় ডিগ্রী প্রদানে সক্ষম যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে। তবে সে ডিগ্রী হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও গ্রহনযোগ্য। গবেষনা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ। কলেজকেও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলা হয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল পার্থক্য হচ্ছে গবেষনায়, নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান সৃষ্টিতে। মৌলিক বিষয় নিয়ে গবেষনা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। যদিও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে ধারার বাইরে। সেজন্যই আজ বিশ্বের হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা হয় সভ্যতার ধারক ও বাহক। সেই হিসেবে বলা যায় আমাদের এতদঞ্চলে যেহেতু সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো সেহেতু আমরা পৃথিবীর যেকোনো জাতি থেকে বেশী সভ্য। ধীরে ধীরে যখন আমাদের এতদঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংস করা হলো প্রকারান্তরে আমরা আমাদের সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়লাম। আমাদের দেশে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এতদঞ্চলে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা হচ্ছে। বিভিন্ন আবিষ্কার হচ্ছে। গবেষণা হচ্ছে। সিলেট অঞ্চলের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। (যদিও চন্দ্রপুর নামে একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় মৌলভীবাজার জেলায় ছিল। আমি ও আমার এক ছাত্র যিনি পরবর্তিতে শিক্ষক হয়েছেন মিলে এ সম্পর্কে একটি গবেষণা প্রবন্ধ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় জার্নালে প্রকাশ করি। যার সুত্র ধরে দেশের প্রতœতত্ত বিভাগ ব্যাপক গবেষনা চালাচ্ছে)। যাই হোক, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা ভালো হওয়ায়, দক্ষ উপাচার্য পাওয়ায়, দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান শিক্ষক পাওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় আজকে কেবল সিলেটের নয়; দেশের গর্ব। তাই সিলেটের চতুর্থ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় (অপর দুটি হলো সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) তথা হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সেই ধারায় যাত্রা শুরু করবে সে প্রত্যাশা রইলো।
হবিগঞ্জে দেশের ৭ম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হতে যাচ্ছে। আমরা খুবই উল্লসিত। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান যাতে আমাদের কৃষিসহ প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ নিয়ে গবেষনা করে জ্ঞানের নব ধারা উন্মোচন করে সে প্রত্যাশা রইল। আমাদের এ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যই হচ্ছে কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ও সমতা অর্জন এবং জাতীয় পর্যায়ে কৃষি বিজ্ঞানে উন্নত শিক্ষাদানের পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রচলিত অন্যান্য বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনসহ দেশে কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার সম্প্রসারণ। তাই রাজনৈতিক রেষারেষি ও সংকীর্ণ মনোবৃত্তি থেকে মুক্ত হয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু দেশের নয়; বিশ্বের একটি সেরা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু গতানুগতিক ডিগ্রীধারী সৃষ্টি হবে না; এখান থেকে উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। যার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে আমাদের এলাকায়, সমগ্র দেশে, দেশের গন্ডি পেড়িয়ে সমগ্র বিশ্বে। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি হবে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশে নতুন নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হবে; প্রযুক্তির উদ্ভাবন হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নব দ্বার উন্মোচন হবে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে, দেশ সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হবে।
এজন্য একজন সত্যিকারের স্কলার, মেধাবী, সৎ, নিষ্ঠাবান, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষাবিদকে এখানে শীর্ষ পদে তথা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের বিকল্প নেই। কারন একজন ব্যক্তির মধ্যে দেশপ্রেম না থাকলে; দেশের নীতি আদর্শ তথা মূলনীতির উপর বিশ্বাসী না হলে তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। উপাচার্য তার কর্মকান্ডের জন্য সিন্ডিকেট (যার প্রধান তিনি নিজেই) এর নিকট দায়বদ্ধ। বৃহৎ অর্থে আচার্য বা রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতেই কয়েক হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো নির্মান হবে। হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। সবই হবে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের মাধ্যমে। এ প্রতিষ্ঠানে যদি একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি নেতৃত্বে না থাকেন তাহলে কিন্তু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হবে। হবিগঞ্জবাসীর উল্লাস দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিবে। যা আমাদের মোটেই কাম্য নয়। স্বাগতম হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার সম্প্রসারনে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রাখবে এ প্রত্যাশা।
ড. জহিরুল হক শাকিল
অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।