স্টাফ রিপোর্টার ॥ বানিয়াচংয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আটজন নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের নিয়ে ভিন্নমত তৈরী হয়েছে। ঘটনার দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি পুলিশ।
কে হচ্ছেন হত্যা মামলার বাদী; আর কারা আসামী সিদ্ধান্ত হয়নি এসব বিষয়েও। নিহতদের পরিবারের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগের অন্যতম বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংশয়ের দেয়াল। এ পরিস্থিতিতে মামলা নিয়ে অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দে স্বজনরা।
কিশোর কাঠমিস্ত্রী আশরাফুল হত্যা মামলা দায়ের নিয়ে তাঁর দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ির লোকজনের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিয়েছে বলে নিহতের মা মাহমুদা বেগম খোয়াইকে জানান।
তাঁর দাবি আশরাফুলের মামারা বলছেন “আমাদের ভাগ্নে আট জনের সঙ্গে শহীদ হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা তাতে সম্মত।”
“আর দাদাবাড়ির লোকজন হত্যার সঙ্গে জড়িত নয় এমন লোককে আসামী দিতে চান” উল্লেখ করে মাহমুদা বেগম বলেন, ‘আমার বুকের ধনকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
গুলিতে আটজন নিহতের ষোল দিন পরও পুলিশের পক্ষ থেকে নিহত আশরাফুলের পরিবারের খোঁজ নেওয়া হয়নি উল্লেখ করে আশরাফুলের মা জানান, গতকাল বুধবার বিকাল পর্যন্ত মামলার ব্যাপারে তাঁরা কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারেননি।
এরপর মামলা প্রসঙ্গে কথা হলে নিহত মোঃ হাসাইন মিয়ার (১২) পিতা মোঃ সানু মিয়া হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, মামলা দায়েরের জন্য এলাকার কিছু লোক তাগিদ দিচ্ছেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে যেতে চান না।
সানু মিয়ার ভাষ্যÑ ‘একে তো আমি আমার পোলা হারাইছি। আরেকবার মামলায় নিরপরাধ মানুষ ঢুকলে আমি আল্লাহর কাছে জবাব দিতাম পারতাম না। এর লাইগ্যা কোন সিদ্ধান্ত নিতাম পারছি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশরাফুল ও হাসাইনের পরিবারের মত নিহত অন্যদের পরিবারও হত্যা মামলা দায়ের নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন। কয়েকটি পরিবার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বিধায় পরিবারের সদস্যরা দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন।
বানিয়াচংয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা কয়েকজন খোয়াইকে জানান, পরিবারগুলো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন মামলা দায়েরে বিলম্বসহ দ্বিমত দেখা দেওয়ায় তারা আরও ভেঙ্গে পড়ছেন। দ্রুত এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো প্রয়োজন।
এদিকেÑ পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, যেহেতু একই ঘটনায় অনেকগুলো মানুষের প্রাণ গেছে; তাই একটি হত্যা মামলা দায়েরের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এ বিষয়ের অগ্রগতি প্রসঙ্গে আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
যোগাযোগ করা হলে হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা খোয়াইকে বলেন, ‘ঘটনার দিন যারা নিহত হয়েছেন তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ তা কিন্তু নয়। অনেকে মনে করতে পারেন আমি তাঁদের প্রভাবিত করতে চাই। এজন্য যোগাযোগ করিনি।’ ‘এ কর্মকর্তা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে’ কথাটিও যোগ করেন।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট সকাল ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সাগরদিঘীর পশ্চিমপাড় ঈদগাহ মাঠ থেকে মিছিল বের করে। গ্যানিংগঞ্জ বাজার প্রদক্ষিণ শেষে মিছিলকারী ৪/৫ হাজার লোক বড়বাজার শহীদ মিনারে গিয়ে জড়ো হন। পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন মিছিল নিয়ে থানার সামনে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের কথা কাটাকাটি হয়। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।
ঘটনার সময় পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে চারজনসহ সাতজন নিহত হন।
তখন চিত্র ধারণ করতে গেলে বিক্ষুব্ধরা এক সাংবাদিককে পিটিয়ে হত্যা করে। মোট মৃতের সংখ্যা হয় নয়। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা থানার উপপরিদর্শক সন্তোষকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরদিন গুলিবিদ্ধ আরেকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
এরপর স্থানীয় লোকজন থানায় আক্রমণ করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন এবং পুলিশ সদস্যদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এরপর গত ১৫ আগস্ট ১২ জন পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে যোগ দেন।