আবুল কালাম আজাদ, চুনারুঘাট থেকে ॥ অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে চুনারুঘাট উপজেলার সাটিয়াজুরী ইউনিয়নের দ্বারাগাঁও এলাকা তছনছ হয়ে গেছে। বসতভিটা হারাচ্ছেন গ্রামের দরিদ্র মানুষ। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ লাইন, কবরস্থান ও শ্মশানঘাট ভেঙ্গে পড়ছে।
জানা গেছে, প্রায় ৭৫টি ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে হুমকিতে মসজিদ, মক্তব ও স্কুল-মাদ্রাসা। ইতিমধ্যে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এনিয়ে কথা বলায় স্থানীয় যুবকদের হুমকি দিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। ৪০ থেকে ৪৫ বালু খেকোর আচরণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ, বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী দ্বারাগাঁও।
এদিকে গত রবিবার বিকেলে সহকারি কমিশনার (ভূমি) মিল্টন চন্দ্র পালের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত এ গ্রামে অভিযান চালিয়ে ২৬টি ড্রেজার মেশিন এবং প্রায় ৫ হাজার ফুট পাইপ জব্দ ও ভেঙ্গে নষ্ট করেন। বালু উত্তোলনের দায়ে দু’জনকে কারাদন্ডও দিয়েছেন।
গ্রামের যুবকরা জানান, চুনারুঘাট উপজেলার দ্বারাগাঁও গ্রামের কয়েকজন নেতা বালু সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তাদের শেল্টার দিচ্ছে পাশ্ববর্তী বাহুবলের জয়পুর গ্রামের আরেকটি চক্র। এ চক্রটি গ্রামের ৩০/৩৫ জনের কাছ থেকে জমি কিনে বড় বড় ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে এবং ট্রাক, ট্রাক্টর ও ১২ চাকার গাড়ি দিয়ে বালু পরিবহন করে কামাইছড়া এলাকার ডিপোতে নিয়ে সেখান থেকে বিক্রি করে। বালু বিক্রি করে তারা কোটিপতি হলেও গ্রামের মানুষ হচ্ছে নিঃস্ব। তার মধ্যে গ্রামে বালু সিন্ডিকেটের সদস্যদের অনেকেই এখন চুনারুঘাট, শ্রীমঙ্গল ও মিরপুর এলাকায় কোটি টাকা খরচে বাড়ি করে বসবাস করছেন। গ্রামে তারা যান শুধু বালু ব্যবসার জন্য। অথচ গ্রামের মানুষ তাদের ফসলি জমি থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করার কারণে বসতভিটা হারাচ্ছেন। রাস্তাঘাটের অবস্থা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রামে যাওয়ার রাস্তাগুলো এখন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে। গ্রামের কোন গর্ভবর্তী মহিলা কিংবা রোগীকে এখন আর হাসপাতালে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। ফসলি জমিতে বালুতে ভরে যাওয়ায় তাদের ধান গাছ বাড়ছে না। চিন্তায় আছেন কৃষকরা আগামী দিনে তারা কি খাবেন। কারণ ধান না হলে তাদের না খেয়ে মরতে হবে। গ্রামের দরিদ্র কৃষকরা এখন এক চরম বিপদে আবর্তিত হচ্ছেন। তারা ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। প্রভাবশালী মহলটি তাদের জমির উপর দিয়ে জোরপুর্বক বালু উত্তোলনের পাইপ নিয়ে গেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাদের মারধোর করা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীরা রয়েছেন চরম আতংকে। প্রতিদিনি আড়াই থেকে ৩শ ট্রাক, ট্রাক্টর দিয়ে পরিবহন করা হচ্ছে বালু। এতে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাচ্ছে। পাশাপাশি দরিদ্র লোকজন যারা এলাকায় টমটম, রিক্সা চালিয়ে জীবণ ধারণ করেন তারাও রয়েছেন চরম দুর্ভোগে। ট্রাক্টর আর ট্রাকের কারণে তারা যান চালাতে পারছেন না। এ নিয়ে বালু খেকোদের সাথে তাদের প্রায়ই দেন দরবার ও হাতাহাতি হচ্ছে।
গ্রামের সিন্ডিকেট সদস্যরা তাদের জমি বালু ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন। বালুখেকোরা প্রত্যেকে ৮/১০টি ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে জমি থেকে বালু উত্তোলন করছেন। এভাবে বালু উত্তোলনের কারণে কামাইছড়া থেকে দ্বারাগাও পর্যন্ত ৫টি ব্রীজ রয়েছে চরম হুমকিতে। যে কোন সময় এসব ব্রীজ ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। একই ভাবে বালু পরিবহন ও উত্তোলনের কারণে হুমকির মধ্যে রয়েছে দ্বারাগাও চা বাগান।
প্রতিবন্ধি আকছির মিয়া জানান, আমার ভাই কাদির মিয়ার ৪০ শতক জমি বালুতে ভরে গেছে, কোন ধান হয় না। এর প্রতিবাদ করলেই তারা দা, লাটি ফিকল নিয়ে আমাদের উপর হামলা চালায়। আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারি না। গ্রামের যুবক সিফু খান বলেন, গ্রামের কৃষি জমিতে বড় বড় গর্ত করে ৭০টি ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে একটি প্রভাবশালী মহল। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাদেরকে চাদাবাজি মামলা দেওয়ার হুমকি দেয়। তিনি বলেন, গ্রামের কৃষকরা দিনে দিনে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, গ্রামের শত শত একর জমি এখন গর্তে পরিণত হয়েছে। দরিদ্র হাছেনা খাতুন বলেন, ক’দিন পরই আমার ঘর ভেঙ্গে যাবে, আমার স্বামী নাই, আমি তখন ৩টা বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব এ চিন্তায় আছি।
এ বিষয়ে সাটিয়াজুরী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ বলেন, দ্বারাগাঁও গ্রামে বালুখেকোরা হরিলুট চালাচ্ছে, সকল দলের লোকজন মিলেই গ্রামে বালু উত্তোলন করছে। গ্রামের বাড়িঘরের প্রতি তাদের কোন দরদ নেই। তিনি এ বিষয়ে উপজেলা সভায় বার বার অবগত করছেন বলেও জানান। তিনি বলেন গ্রামবাসীকে এ বিষয়ে সচেতন না হলে ভয়াবহ পরিণতি হবে।
সহকারি কমিশনার (ভুমি) মিল্টন চন্দ্র পাল বলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও পরিবহনকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। প্রতিদিনই ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা, মেশিন ও পাইপ পুড়িয়ে দেওয়া এবং আটক অভিযান চলছে। দ্বারাগাও গ্রামের বিষয়টিও দেখা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সত্যজিত রায় দাশ বলেন, সরকারি নিয়মের বাইরে জমি থেকে এবং অবৈধভাবে যে কেউ বালু উত্তোলন করলে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনে যাচ্ছি।