স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ প্রতিটি স্বাধিকার আন্দোলনেই হবিগঞ্জের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। এ সকল আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অনেকেই জীবিত না থাকলেও কালের স্বাক্ষী এবং সমাজের বিবেক হিসাবে রয়েছিলেন ভাষা সৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রবীন আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে তিনিও মারা গেলেন। সৈয়দ আফরোজ বখতকে অসুস্থ অবস্থায় সিলেটে নেয়ার পথে নবীগঞ্জে মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় হবিগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা প্রশাসন। এ সময় হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহিরসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বুধবার বানিয়াচং উপজেলার করচা গ্রামে ২য় জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। তবে এখনও ২য় জানাযার সময় চুড়ান্ত হয়নি। মৃত্যুকালে সৈয়দ আফরোজ বখত স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রেখে যান।
আফরোজ বখত ১৯৫২ সালে ছিলেন মেট্রিক পরীক্ষার্থী। মাতৃভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে ছিলেন সংগঠক। হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পায়ে হেটে তিনি সংগঠিত করতেন ছাত্রছাত্রীদের। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার পর থেকে কর্মক্ষেত্রে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার ব্যবহার করেননি তিনি। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত হলেও তিনি কর্মক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার করতেন না। মামলার আরজি, জবাব সবই লিখতেন বাংলায়। অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত ১৯৩৫ সালের ৩১ মার্চ বানিয়াচং উপজেলার করচা গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ খুরশেদ আলী ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। তিনি প্রাইমারী স্কুলে লেখাপড়া করেন মথুরাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সন্দলপুর বিসিএমই স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে মিডল ইংলিশ স্কুল লিবিং সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাশ করেন। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। পরে সরকারি বৃন্দাবন কলেজে ভর্তি হয়ে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। ১৯৫৩ সালে এইচএসসি পাশ করার পর সেখানেই ¯œাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৫-১৯৫৬ সেশনে কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। ’৫৮ সালে বিএ পাশ করেন। ’৬৫ সনে ঢাকা সিটি ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন। ওই সময়ে কিছুদিন মহাহিসাব রক্ষণ অফিসে চাকুরীও করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ন্যাপ (ওয়ালি-মোজাফফর) হবিগঞ্জ মহকুমার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা সিভিল ডিফেন্স একাডেমিতে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৫ ইং সনে পাক ভারত যুদ্ধের সময় ঢাকাতে সিভিল ডিফেন্স ওয়ার্ডেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গঠিত কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইয়ুব আন্দোলন গঠিত ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি হবিগঞ্জ শাখার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক হবিগঞ্জ মহকুমা স্বাধীনতা আন্দোলনের গঠিত সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ভারতের ত্রিপুরায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি তখন ভারতের ত্রিপুরায় খোয়াই মহুকুমা এসডিও জে পি গুপ্ত, আইসিএস অরুণ কর (পরবর্তীতে ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী), ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, ত্রাণ বিভাগের মহাপরিচালক সায়গলসহ আরও সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তাদের সহযোগিতায় শরণার্থী শিবিরের বহু সমস্যার সমাধান করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করে উর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। এর আগেই ১৯৬৭ সনে তিনি হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এই সমিতির তিনবারের সভাপতি এবং একবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। হবিগঞ্জ মহকুমার জিপি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বাকশাল গঠিত হলে হবিগঞ্জ শাখার তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৮৩ সনে রাশিয়া সরকারের আমন্ত্রণে রাশিয়া ভ্রমন করেন। ১৯৭৪ সালের ২৮ জুলাই তিনি হুসনে আরা কোরেশির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্দ হন। তার স্ত্রী ছিলেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের মহিলা সম্পাদক। অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ সামায়ুন বখত তার সাথে আইন পেশায় জড়িত রয়েছেন। সৈয়দ হুমায়ুন বখত ব্যাংকার এবং সৈয়দ সাইমুন বখত বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী। একমাত্র মেয়ে ডাঃ সৈয়দা ইসরাত জাহান দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করার পর ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন এবং সেখানেই এমআরসিপি সম্পন্ন করেন। অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত হবিগঞ্জ বারে আইন পেশায় ৫০ বছর অতিক্রম করায় সমিতি তাকে সংবর্ধনা দেয় এবং স্বর্ণপদক প্রদান করে।
অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির এমপি, দৈনিক খোয়াই সম্পাদক শামীম আহছান, সাবেক এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল, আওয়ামী আইনজীবি সমিতির সেক্রেটারী নিলাদ্রী শেখর পুরকায়স্ত টিটু, জেলা পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ, অ্যাডভোকেট শাহ ফখরুজ্জামান, জেলা ছাত্রলীগ সাবেক সভাপতি মোস্তফা কামাল আজাদ রাসেল।