শাহ ফখরুজ্জামান ॥ ১০ মাস ১০ দিন মায়ের পেটে লালিত হওয়ার পর আলো বাতাসের ধরাধামে শিশু যখন ভূমিষ্ট হয় তখন চিৎকার দিয়ে তার আগমনী বার্তা জানান দেয়। এই চিৎকার বা কান্না যে কোন দম্পত্তি বা তার স্বজনদের বহু আকাঙ্খিত। জন্মের পর নবজাতক মায়ের কোলে লালিত হবে। তার একটি নাম হবে। সবার আদরে বড় হবে। এটিই সবার কাম্য। কিন্তু মায়ের নাড়ী ছেড়ে পৃথিবীতে এসে যখন নিজের নাম ধারন করার পূর্বেই নবজাতককে পড়তে হয় জীবন সংকটে; তখন দিশেহারা হয়ে যান অভিভাবকরা। সন্তানের জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেন হাসপাতালে। মানব জীবনের বিভিন্ন সংকট মোকাবেলা করে টিকে থাকার ইতিহাস থাকলেও নবজাতকরা এই সংকট থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। কারন আমরা তাদের রক্ষার্থে হাসপাতালে অনুকূল পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হয়েছি। হবিগঞ্জবাসীর সামনে এই কঠিন বাস্তবতা থাকলেও এ অবস্থার পরিবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এক সময় হবিগঞ্জের নাম ছিল পিছিয়ে পড়া জনপদের তালিকায়। কিন্তু অলি আউলিয়ার পূণ্যভূমিতে থাকা বিপুল সম্পদ আর সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে হবিগঞ্জ এখন আলোকিত এক জনপদে পরিণত হয়েছে। শিল্পায়ন ও ভৌগলিক কারণে হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মফস্বল জেলা শহর হলেও এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ। নিকট ভবিষ্যতে শুরু হতে যাচ্ছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু অবকাঠামো আর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই এখনও পিছিয়ে আছি। এ বিষয়টি আমি বার বার উপস্থাপন করেছি। যেমন, শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা অবস্থার পরিবর্তনের জন্য এখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ প্রতিষ্ঠা, বিদেশে কর্মী প্রেরণের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা, শুধু ভবন না করে হাসপাতালের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো, বিনোদন ও পরিবেশেন উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া। এই মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে না ভাবার পরিণতি আমাদের দেখিয়েছে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের স্ক্যানুতে নিয়মিত হারে নবজাতকের মৃত্যুর বিষয়টি। এর বাহিরে জেলায় অবৈধ ক্লিনিক, ভূয়া চিকিৎসকের দৌরাত্ম, হাসপাতালে দালালের হয়রানী, সিজার সংস্কৃতি তৈরি, ফার্মেসিতে মেয়াদ উত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রিসহ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিরাজমান ভয়াবহ ধরনের অনিয়ম তো আছেই। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু অভিযান পরিচালিত হলেও অবস্থার খুব বেশী উন্নতি হয়নি।
সাংবাদিক হিসাবে জেলা সদরের হাসপাতালকে নিয়ে আমরা সবাই প্রতিবেদন করি। বলা চলে এটি একটি সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রতিবেদন করার পর যখন কর্তৃপক্ষ সেগুলো আমলে নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখন সাংবাদিকদের ভাল লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। আবার আমরা প্রতিবেদন করার পূর্বেই যখন প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালের উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্পের ঘোষণা দেন তখন নাগরিক হিসাবে আমরা আনন্দিত হই। বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশী নমুনা গ্রহণ ও আক্রান্তের হার থাকায় বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার কলাম লিখি। এই কলামের বিষয় ছিল হবিগঞ্জে একটি পিসিআর ল্যাব স্থাপন। এর যৌক্তিক কারণগুলো উপস্থাপন করি। পরবর্তীতে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি আমলে নিয়ে উদ্যোগ নেন। সরকার থেকে ঘোষণা আসে পিসিআর ল্যাব হওয়ার। লোকবলও পোস্টিং দেয়া হয় এই ল্যাবের জন্য। কিন্তু করোনার প্রথম ওয়েব এর পর দ্বিতীয় ওয়েব শুরু হলেও এখন পর্যন্ত পিসিআর ল্যাব হয়নি হবিগঞ্জে। এই বিলম্বে হতাশা কাজ করলেও যেহেতু নতুন আর একটি বিষয় চোখে পড়েছে তা নিয়ে কিছু লিখার জন্যই আজকের এই কলামের অবতারণা।
কয়েকদিন পূর্বে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের এক সূত্রের মাধ্যমে জানতে পারি সেখানে চিকিৎসকের অবহেলায় এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলছে হট্টগোল। ছুটে যাই সেখানে। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত স্ক্যানোর সামনে গিয়ে জানতে পারি মাধবপুর উপজেলার শাহপুর গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী মন্নর আলীর প্রথম সন্তানকে অসুস্থ অবস্থায় সেখানে ভর্তির পর মৃত্যু বরণ করেছে। মন্নর আলীর বক্তব্য ছিল, এখানে যেহেতু চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল, তাকে রেফার্ড করা হলে সিলেটে চলে যেতে পারত। মন্নর আলীর স্ত্রী বিউটি আক্তার নিজ বাড়ীতে স্বাভাবিকভাবেই জন্মদেন শিশুটির। পরে অবস্থা খারাপ হওয়ায় চলে আসেন হবিগঞ্জে। ডাক্তারের পরামর্শে ভর্তি করেন হাসপাতালে। কিন্তু বাড়ীতে তাদের ফিরতে হয় নবজাতকের লাশ কোলে। তখন পর্যন্ত ওই নবজাতকের কোন নামই রাখা হয়নি। একই দিন সেখান থেকে হবিগঞ্জ শহরের নোয়াবাদ এলাকার গৃহবধু মাশকুরা বেগমও বাড়ী ফিরেন নবজাতকের লাশ কোলে। এই দৃশ্য দেখে এর কারণ অনুসন্ধান শুরু করলাম।
হাসপাতালের স্ক্যানুর অফিসিয়াল তথ্য থেকে দেখতে পাই, গত ২৯ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ দিনে স্ক্যানুতে মারা গেছে ২৩ নবজাতক। এর বাইরে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে মারা গেছে আরও একজন। এগুলো যথাক্রমে (স্ক্যানু) ২৯ নভেম্বর ১জন, ৩০ নভেম্বর ২জন, ১ ডিসেম্বর ২জন, ২ ডিসেম্বর ৪জন, ৩ ডিসেম্বর ১জন, ৪ ডিসেম্বর ২জন, ৫ ডিসেম্বর ২জন, ৬ ডিসেম্বর ১জন, ৭ ডিসেম্বর ১জন এবং শিশু ওয়ার্ডে ১জন, ৮ ডিসেম্বর ৩জন, ৯ ডিসেম্বর ২জন ও ১০ ডিসেম্বর ২জন। মারা যাওয়াদের মাঝে জেলার ৯ উপজেলার পাশাপাশি কিশোরগঞ্জ জেলারও রোগী ছিল, যা অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। প্রাইভেট হাসপাতালে বা ঢাকা সিলেট নিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন না বলেই তারা অসুস্থ নবজাতককে এখানে নিয়ে আসেন। হাসপাতালটিতে যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলেই জানান তারা।
হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালটি ১০০ শয্যার ছিল। বর্তমানে সেখানে ১টি ৭ তলা ভবন নির্মাণ করে ২৫০ শয্যা করা হয়েছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ এরও অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসাবে কার্যক্রম চলছে। কিন্তু হাসপাতালে ডাক্তার এবং নার্স এর সংখ্যা অপ্রতুল। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে সব সময় রোগীদের উপচেপড়া ভীড়। বিশেষ মৌসুমে সিটের ৩/৪ গুণ রোগীও ভর্তি থাকে সেখানে। ৪/৫ বছর পূর্বে এনজিও মা-মনির সহায়তায় হাসপাতালের ২য় তলায় নবজাতকদের জন্য একটি স্ক্যানু তৈরি করা হলে শিশু ওয়ার্ডে চাপ কমে। তবে সেই স্ক্যানুর অবস্থা বর্তমানে মুমুর্ষ। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ইনকিউবেটর ও ওয়ার্মারও নেই। একটি ওয়ার্মারে একটি শিশু রাখার কথা থাকলেও রাখা হয় ৪শিশু। আবার বর্ষাকালে এই স্ক্যানো থাকে পানি বন্দি। স্ক্যানোতে ১১টি ওয়ার্মার এর মধ্যে ভাল অবস্থায় আছে ৭টি আর নষ্ট ৪টি। ফটো থেরাপীর জন্য তিনটি মেশিন থাকলেও ২টি নষ্ট। স্ক্যানুতে রোগীর আধিক্য ও মেশিনগুলোর কার্যকারিতার অভাবই নবজাতকের মৃত্যু বেশী হওয়ার কারণ বলেই অনুসন্ধানে উঠে আসে।
ডাক্তার ও কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপকালে জানতে পারি, নবজাতকের এই সমস্যার শুরু হয় অসচেতনতা এবং দারিদ্রতা থেকে। বিশেষ করে গ্রামের অশিক্ষিত ও দরিদ্র নারীরা প্রশিক্ষণহীন ধাত্রী দিয়ে ডেলিভারী করাতে গিয়ে সমস্যা পড়েন। ফলে জন্মের পরই নবজাতকের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। আবার গ্রামে ডেলিভারীর চেষ্টা করে যখন মায়ের অবস্থা খারাপ হয় তখন তাদেরকে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। আর এর মাঝেই নবজাতকের ক্ষতি হয়ে যায়। আবার নবজাতক অসুস্থ হলেও অনেকেই চলে যান পল্লী চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে দেরীতে আসেন। ফলে তাদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে নবজাতককে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য স্ক্যানুর সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। এর জন্য প্রয়োজন এনআইসিইউ। আবার হবিগঞ্জে এনআইসিইউ না থাকায় দরিদ্র অভিভাবকদের ঢাকা-সিলেট যাওয়াও সম্ভব হয় না। ফলে নবজাতকের মৃত্যুর হার বেশী। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য প্রয়োজন হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে একটি এনআইসিইউর ব্যবস্থা করা। কিন্তু চাইলেই কি তা সম্ভব। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন দেশের সকল জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ হবে। এটি হলে বড়দের সুবিধা হবে। নবজাতকদের জন্য প্রয়োজন এনআইসিইউ। যেহেতু হবিগঞ্জে নবজাতকের মৃত্যুর হার বেশী এবং এখানকার বিপুল জনগোষ্ঠীর সামর্থ্য কম, তাই আমি মনে করি সরকারের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারলে আমরা এনআইসিইউ পেতে পারি। এই প্রত্যাশার যায়গাটি অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই তৈরি করেছেন। কারন এর আগে তিনি আমাদেরকে মেডিকেল কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক উন্নয়ন দিয়েছেন। এনআইসিইউ হলে শুধু হবিগঞ্জবাসী নয়, এর সুফলপাবে আমাদের পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলার মানুষও। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের এই জেলার নবজাতকের চিকিৎসা সংকট দূর করবেন বলে আশায় বুক বাঁধতেই পারি।
লেখকঃ
আইনজীবী ও সাংবাদিক