শাহ ফখরুজ্জামান॥ আমরা যখন স্কুলে যাই তখন মফস্বল জেলা শহর হবিগঞ্জে কয়েকটি কিন্ডার গার্টেন যাত্রা শুরু করে। যদিও সারা দেশে এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই চালু ছিল। অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তখনই সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্ডার গার্টেন এর সাথে আমাদের পূর্ব পরিচয় না থাকায় আমরা এর উচ্চারণ করতাম কিন্ডার গার্ডেন। আবার বয়স যখন বাড়তে থাকে তখন বিভিন্ন সভা সমাবেশে গেলে শুনতে পেতাম হবিগঞ্জকে বলা হয় পিছিয়ে পড়া হবিগঞ্জ। এ পরিচয়কে সামনে নিয়েই উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করি। যখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেতাম তখন নিজ জেলার সাথে তাদের তুলনা করে ও বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত জেনে মন খারাপ হত। কারন অনেক সূচকেই হবিগঞ্জের অবস্থান ছিল একেবারেই নি¤েœ।
এই পিছিয়ে পড়া জনপদ থেকে থেকে আলোকিত হবিগঞ্জে রুপান্তর ছিল আমাদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন। তবে কিভাবে হবে তা জানা ছিল না। হবিগঞ্জের যে কোন উন্নয়নই আমাদের আলোড়িত করত। আমরা এতই উন্নয়ন প্রত্যাশী ছিলাম যে, যখন শহর থেকে ধুলিয়াখালে কারাগার স্থানান্তর হয় তখন এই উন্নয়নের জন্য আমরা তৃপ্তি পেয়েছিলাম। আবার আমাদের পরিচিত জনরা কারাগার প্রতিষ্ঠায় আমাদের আনন্দ দেখে মুচকি হাসত। হবিগঞ্জ শহরের জালাল স্টেডিয়ামে কত বক্তৃতায় নিজে বলেছি এবং অতিথিদেরকে বলতে শুনেছি হবিগঞ্জে আধুনিক স্টেডিয়াম চাই। কিন্তু কিছুই যেন হচ্ছিল না। তবে বাংলাদেশের আধুনিকায়নের স্বপ্ন দ্রষ্টা এবং দেশকে এগিয়ে নেয়ার মূল নায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই যেভাবে হবিগঞ্জকে দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ মনে করে উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে থাকেন তখন হবিগঞ্জ যে আলোকিত হবে তাতে আর কোন সন্দেহ থাকে নি। আর এই স্বপ্ন পূরণে কিভাবে দিনরাত মাঠে-ময়দানে কাজ করছেন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি এডভোকেট মো. আবু জাহির; তাও সকলেই অবগত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও এমপি এডভোকেট মো. আবু জাহির এর মেল বন্ধনে ব্যাপক উন্নয়নে সত্যিই বদলে যাচ্ছে হবিগঞ্জ।
২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হবিগঞ্জে এসে উদ্বোধন করেন হবিগঞ্জবাসীর বহু প্রত্যাশিত হবিগঞ্জ আধুনিক স্টেডিয়াম। এর সাথে আরও অনেক উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেন। পরে নিউফিল্ডে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হবিগঞ্জবাসীর পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট মো.আবু জাহির দাবী করেন একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা, একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, শায়েস্তাগঞ্জকে উপজেলায় রুপান্তর এবং বাল্লা স্থল বন্দর আধুনিকায়ন। এই দাবীগুলো উত্থাপনের পূর্বেই আমাদের সংসদ সদস্য অনেক হোম ওয়ার্ক করেছেন। দাবীগুলো ছিল স্বপ্নের চেয়েও বড়। তাই দাবীগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাখবেন কিনা বলে অনেকেই সন্দেহ পোষন করেন। কিন্তু সেই সভার সভাপতি এমপি আবু জাহির তার বক্তব্যে লক্ষ জনতার হাততালির মধ্যে যখন দাবীগুলো উপস্থাপন করেন তখন প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় সবগুলোই গ্রহণ করেন। ফলে আনন্দে মুখরিত হয়ে পড়ে নিউফিল্ড।
প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঘোষণার পরও অনেক নেতিবাচক মনোভাবের মানুষ এই ঘোষণা বাস্তবায়নে সন্দেহ পোষণ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা যে তথাকথিত ঘোষণা নয় তার প্রমাণ পেতে বেশী সময় লাগেনি হবিগঞ্জবাসীর। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার কিছুদিন পরই হবিগঞ্জে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও চালুর ঘোষণা আসে। পরে সেটি অস্থায়ী ক্যাম্পাসে চালু হয়। কৃতজ্ঞতা জানাতে এটির নাম করণ করা হয় শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ। এই নাম করণের পিছনেও রয়েছে এমপি আবু জাহিরের অবদান। পরে বাস্তবায়ন হয় শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা। এই উপজেলা বাস্তবায়ন অনেক কষ্ট সাধ্য কাজ। উপজেলা করার জন্য প্রথমেই নুরপুর ইউনিয়নকে ভেঙে ব্রাক্ষণডুরা ও নুরপুর ইউনিয়ন করা হয়। পরে ধাপে ধাপে দেশের সর্বশেষ উপজেলা হিসাবে রুপান্তরিত হয় শায়েস্তাগঞ্জ। নতুন উপজেলা ও জেলা করা যে কতটা জটিল তার একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান ভৈরবকে আলাদা জেলা করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় ঘোষণা চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা স্থল বন্দর প্রকল্পটি ইতোমধ্যে একনেকে পাশ হয়েছে। সেখানে কাস্টমস এর স্থাপনার জন্য ৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বন্দরের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১৩ একর জমি। বন্দরটি দ্রুত বাস্তবায়ন হবে এই প্রত্যাশা সবার।
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় ঘোষণাটি পরিপূর্ণ হল গতকাল বৃহস্পতিবার যখন মহান জাতীয় সংসদের অধিবেশনে হবিগঞ্জে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি পাশ করা হল। এখন আমাদের প্রত্যাশা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে এটি যাতে দ্রুত দৃশ্যমান হয় সেদিকে মনোনিবেশ করা।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৪টি দাবী উত্থাপনের সময় আমরা সন্দিহান ছিলাম। এত বড় বড় প্রকল্প তিনি মেনে নিবেন কি না। কিন্তু ৪ টি ঘোষণাই বাস্তবায়নের পর বরং এখন আমাদের আফসোস হচ্ছে কেন আরও কিছু দাবী জানানো হল না। প্রধানমন্ত্রী হবিগঞ্জবাসীর প্রতি এতটাই আন্তরিক যে আরও দাবী জানালেও তা তিনি মেনে নিতেন বলেই আমার মনে হয়। তবে এই ঘোষণার বাহিরেও কিন্তু আরও বড় বড় প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেকের সভায় অনুমোদন হচ্ছে। যেমন চুনারুঘাট উপজেলার চানপুর চা বাগানের পাশে ইকনোমিক জোন, নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর বাধ সুরক্ষার বিশাল প্রকল্প, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সড়ককে শাল্লার সাথে যুক্তকরণ প্রকল্প, লাখাই-নাছিরনগর-সরাইল সড়কটিকে আঞ্চলিক মহাসড়কে রুপান্তরের কাজ। একনেকে অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে হবিগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খোয়াই নদীর ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এভাবে আরও অনেক প্রকল্পই অনুমোদন হচ্ছে। চুনারুঘাট উপজেলার পানছড়িতে ইকো রিসোর্টসহ জেলার পর্যটন বিকাশেও নেয়া হচ্ছে অনেক প্রকল্প। ব্যক্তিপর্যায়ে এখানে বহু বিনিয়োগ চলে এসেছে। বড় ধরনের শিল্পায়ন হচ্ছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে। মহাসড়কটিও ৪ লেনে উন্নীত করার কাজ এগিয়ে চলছে।
হবিগঞ্জকে বদলে দেয়ার জন্য এখন আমাদের আর দাবী নয় বরং কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। তাই আমরা দাবী জানাই আবার হবিগঞ্জে আসুন প্রধানমন্ত্রী। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আপনি হবিগঞ্জে আসলে আবারও আপনার সভায় জনসমুদ্র হবে। সেখানে আমরা আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব। পাশাপাশি আমরা আরও কিছু দাবীও উত্থাপন করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাদের স্বপ্নকে বড় করে দিয়েছেন। চাওয়ার ক্ষেত্রে যাতে কৃপণ না হই; তারও শিক্ষা দিয়েছেন। এবার আপনি আসলে আর বড় কোন দাবী জানানোর মত কিছু নেই। তারপরও হবিগঞ্জে টিচার ট্রেনিং কলেজ, ট্যাকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, আধুনিক স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ভেন্যুতে রুপান্তর, তেলিয়াপাড়া ডাক বাংলোকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স বাস্তবায়ন, আদিবাসী কালচারাল সেন্টার বাস্তবায়নসহ অনেক দাবী রয়েছে। সেই দাবীগুলোও অত্যন্ত যৌক্তিক। আবার সৈয়দপুরের মত একটি এলাকায় যদি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে পারে তাহলে হবিগঞ্জে একটি অভ্যন্তরীন বিমানবন্দর হওয়াও বড় কোন স্বপ্ন নয় বলে আমি মনে করি। কৌশলগত কারণে এখানে বিমানন্দরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশেষ করে প্যালেস, গ্র্যান্ড সুলতানসহ পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে যারা আসেন তারা বিমানবন্দর হলে আরও স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন। শিল্পাঞ্চলের উর্ধ্বতনরা এবং বিদেশী বায়াররাও আসবে আকাশ পথে। প্রবাসীরা ডমেস্টিক ফ্লাইট ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবীগুলো উত্থাপন করতে পারলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব। তিনি তারই প্রমান রেখেছেন। তাই আমি চাই প্রধানমন্ত্রী আবার হবিগঞ্জে আসুন। হবিগঞ্জবাসী আপনার অপেক্ষায়।
লেখকঃ আইনজীবী ও সাংবাদিক।